যেসব কারণে নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়

যেসব কারণে নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়



মঙ্গলবার, ০১ জানুয়ারি ২০১৯


একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চরম পরাজয়ে বিএনপিতে বিরাজ করছে রাজ্যের হতাশা। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ ঘোষিত ফলাফলে দলটির নেতৃত্বাধীন জোট মাত্র সাতটি আসনে জয়লাভ করেছে।
কয়েকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দলটির কেন এ ফল বিপর্যয় তা নিয়ে সর্বত্রই চলছে আলোচনা। দলটির নেতাকর্মীরাও পরাজয়ের নেপথ্যে নানা কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
বিএনপির নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, এ নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতাসীন দলের ভোট কারচুপি ও অনিয়মই দায়ী। কিন্তু এটাকে পরাজয়ের একমাত্র কারণ মানতে নারাজ অনেকেই।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের অভাব, যোগ্য প্রার্থী দিতে ব্যর্থতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মামলা-হামলায় বিপর্যয়, এজেন্ট দিতে না পারা, বিজয়ের মাসে যুদ্ধাপরাধীদের হাতে ধানের শীষের প্রতীক তুলে দেয়াসহ অন্তত দশটি কারণে ভোটে বিএনপির বিপর্যয় হয়েছে।
দলটির নীতিনির্ধারকরা ইতিমধ্যে এ পরাজয়ের কারণ খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট আসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের আসনভিত্তিক পরাজয়ের কারণ লিখিত আকারে কেন্দ্রে জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হতে পারে। বিপর্যয় বিশ্লেষণ করে পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল চূড়ান্ত করবে দলটি।
জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির পরাজয়ের কারণ বলা খুব দুরূহ। দলটির পক্ষ থেকে ভোট কারচুপির যে অভিযোগ করা হচ্ছে এরা বাইরেও তো আমরা তাদের মাঠে সেভাবে সক্রিয় দেখিনি।
নির্বাচনের দিন তারা মাঠে থাকতে পারেনি। এর মধ্য দিয়ে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। এছাড়া বিজয়ের মাসে জামায়াতকে ধানের শীষের প্রতীক দেয়ায় ভোটারদের একটা অংশ তাদের ভালোভাবে নেয়নি।
তবে এসব কারণ মানতে নারাজ দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার মতে, জনগণ বিএনপির সঙ্গেই ছিল। ক্ষমতাসীনরা বিষয়টি বুঝতে পেরে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার চক্রান্ত করে।
নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিএনপির বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। বিএনপিকে মোকাবেলায় তারা রাষ্ট্রের সব যন্ত্রকে ব্যবহার করেছে।
ফখরুল বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় না তা প্রমাণিত হল। যারা ২০১৪ সালে বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়াকে ভুল বলে এতদিন মায়াকান্না করেছে তারা এবার বুঝতে পেরেছেন কেন আমরা নির্বাচনে যাইনি।
প্রহসনের এ নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে অবিলম্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবি জানান তিনি। যে নির্বাচনে জনগণ তাদের পছন্দের প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করার সুযোগ পাবে।
এবারের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে নেতৃত্ব শূন্যতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন। দলের দ্বিতীয় প্রভাবশালী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে।
দলের প্রভাবশালী দু’জনের নেতৃত্বশূন্যতায় অনেকটা তালগোল পাকিয়ে ফেলে দলটি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য নেতৃত্বের অভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে দলের করণীয় নিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত পায়নি তৃণমূল।
দলের সিনিয়র নেতারা যার যার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ফলে সঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশনা পায়নি দলের প্রার্থীরা। হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত হয়ে কেন্দ্রের নির্দেশনা না পেয়ে অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েন তৃণমূলের নেতারা। কেন্দ্রের নির্দেশনা না পেয়ে নির্বাচনের কয়েকদিন আগে অনেক প্রার্থী হাল ছেড়ে দেন।
ভোটের মাঠে নেতাদের না পেয়ে কর্মী-সমর্থক ও ভোটাররা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন। প্রার্থী ও সিনিয়র নেতারা বারবার নেতাকর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের মাঠে নামার নির্দেশ দিলেও তারাই মাঠে নামেনি। সবার প্রত্যাশা ছিল অন্তত ভোটের দিন নেতারা মাঠে নামবেন।
কিন্তু নির্বাচনের দিনেও তাদের সেভাবে মাঠে দেখা যায়নি। প্রার্থী ও সিনিয়র নেতাদের মাঠে না পেয়ে সাধারণ ভোটাররা ক্ষুব্ধ হন। তাই অনেকে ভোট কেন্দ্রে যাননি। যার প্রভাব পড়ে ফলাফলে।
হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত ছিল দলটির নেতাকর্মীরা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে একাধিক মামলা দেয়া হয়। আগের মামলায়ও অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল। মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে যখনই তারা ভোটের মাঠে নামেন তখনই গ্রেফতারের মুখোমুখি হন। সারা দেশে অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
ফলে নির্বাচনী মাঠে অনেকটা নেতাকর্মীশূন্য হয়ে পড়ে দলটির প্রার্থীরা। পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে মাঠে নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতিকেই দায়ী করছেন অনেকে। যেখানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠে অলিগলি চষে বেড়িয়েছেন সেখানে বিএনপির নেতাকর্মীদের বেশির ভাগই এলাকায় সক্রিয় দেখা যায়নি। অনেক আসনের প্রার্থীকেই মাঠে দেখা যায়নি।
এজন্য মামলাকে দায়ী করা হলেও এটাকে একমাত্র কারণ মানতে নারাজ অনেকে। অনেক আসনে প্রার্থীরা মার খেয়ে নির্বাচনী মাঠে ছিলেন কিন্তু বেশির ভাগ আসনে প্রার্থীরা নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে নামেননি।
বিশেষ করে রাজধানীর আসনগুলোতে বিএনপির প্রার্থীদের তৎপরতা দেখা যায়নি। দু-চারজন ছাড়া কোনো প্রার্থীই সেভাবে গণসংযোগ করেননি। ফলে ধানের শীষের প্রার্থীদের সঙ্গে ভোটারদের একটা দূরত্ব থেকে যায়, যা নির্বাচনে প্রভাব ফেলে।
পোলিং এজেন্ট দিতে না পারাও নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের একটি কারণ বলে মনে করেন অনেকে। এবারের নির্বাচনে বেশির ভাগ কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দিতে পারেনি দলটি। যাদের দেয়া হয়েছিল তারাও ভয়ে কেন্দ্রে যাননি।
সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই পোলিং এজেন্ট দিতে পারেনি- এটাই একমাত্র কারণ নয়। অনেক প্রার্থীই প্রতিটি বুথে পোলিং এজেন্ট নিশ্চিত করার ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলেন না। এ নিয়ে তাদের পূর্বপ্রস্তুতিও ছিল না।
নির্বাচনের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে জোটে রাখাকেও দায়ী করছেন অনেকে। বিজয়ের মাসে তাদের হাতে ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেয়াকে নতুন ভোটারদের বড় একটি অংশ ভালোভাবে নেয়নি। সুশীল সমাজসহ সচেতন নাগরকিও বিএনপির এই কৌশলকে গ্রহণ করেননি, যা ভোটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
গণসংযোগেও ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারেনি বিএনপি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের সঙ্গে জনগণের সংযোগ ছিল না। এবারের নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের কোনো প্রকার গণসংযোগ করতে দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং সিনিয়র নেতাদের দিয়ে যেভাবে গণসংযোগ করেছেন এর বিপরীতে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের নেতাদের একসঙ্গে গণসংযোগে তেমনটা দেখা যায়নি। বলতে গেলে এবারের নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো প্রচারণা ছিল না তাদের।
এসব কারণ ছাড়াও পরাজয়ের পেছনে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও দায়ী ছিল। নেতাকর্মীরা বলছেন, ভোটের মাঠে অনভিজ্ঞ-অপরিচিত, রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয় অনেককে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। যাতে ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
যোগ্য ও ত্যাগীদের বাদ দিয়ে সুবিধাবাদী, কথিত সংস্কারপন্থী ও অন্য দল থেকে এনে অনেককে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েও কোনো ফল পায়নি ত্যাগীরা।
হাইকমান্ডের চাপে তারা নীরব হলেও ভোটের মাঠে আর সক্রিয় হননি। বিশেষ করে কথিত সংস্কারপন্থীদের যেসব আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় সেখানে নেতাকর্মীরা তার পক্ষে মাঠে নামেনি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে দলীয় কিছু ভুল থাকতে পারে। কিন্তু এ নির্বাচনে এটাই প্রমাণিত হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনও অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়।

মন্তব্যসমূহ